**১**
"আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মন্দির,
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তহৃত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা..."
“মা! ও মা! ধুর ধুর! তুমি এখনও ডাকো নি আমাকে? মহালয়া আরম্ভ হয়ে গেছে; ধুর তুমি যে কি করো না মা!”
ধড়ফড় করে উঠে বসলাম, কই মা, নেই তো! ওহ! আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। মোবাইলে চোখ রাখলাম, ওরে বাবা! অনেকটা দেরি হয়ে গেলো, উঠে পরতে হবে; নাহলে আমার ম্যানেজারের ফোন এসে যাবে, শুরু হয়ে যাবে ফিরিস্তি-মর্দিনী।
মোবাইলটা চালিয়ে দিলাম, নাহ! বীরেন বাবুর গলাটা আজও শিরদাঁড়া বেয়ে শারদস্রোত আনতে যথেষ্ট। ব্রাশটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু একটু করে আলো ফুটছে শহরটার বুক জুড়ে।
**২**
“ভাই মহালয়া শুনলি?”
“হ্যাঁ ভাই, অসুরটা কি ভয়ঙ্কর না?”
“হ্যাঁ রে, আর সেই মা দুর্গার সিংহটা!”
“আচ্ছা, শোন ক্যাপ বন্দুক রেডি আছে তো?”
“হ্যাঁ ভাই, বাবা হেবি একটা বন্দুক এনেছে, আর ক্যাপ জানিসই তো সেই সিংহ মার্কা, যা আওয়াজ হচ্ছে, কি বলবো!”
“রোদে দিয়ে দিস ভাই, সপ্তমীর দিন কিন্তু ওপাড়ার ছেলেগুলোর সাথে ফাইট আছে।”
“ঠিক আছে রে! আচ্ছা ভাই এখন যাই, মা লুচি ভাজছে, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে বকা দেবে।”
চায়ের জলটা চাপিয়ে দিলাম, এবারে স্নান করতে যেতে হবে, আজ বড্ড বেশি করে “পুরানো সেই দিনের কথা”-গুলো মনে পরছে। দেওয়ালে টাঙ্গানো গ্রুপ ফটোটা হাতে তুলে নিলাম, নাহ অনেক বন্ধুর সাথেই আজ আর যোগাযোগ নেই, অনেকেই বিয়ে করে শহিদ হয়ে গেছে, আর অনেকে সত্যিকারের “নেই” হয়ে গেছে।
আর একবার যদি ফিরে যেতে পারতাম...... “আবার দেখা যদি হোল সখা, প্রানের মাঝে আয়”...... ফ্রিজটা খুললাম মায়ের হাতের গরম লুচি তো আর নেই, বাসি পাউরুটি দিয়ে কাজ চালাতে হবে।
**৩**
"বাজলো তোমার আলোর বেণু,
মাতলো যে ভুবন;
আজ প্রভাতে সে সুর শুনে খুলে দিনু মন।"
নাহ! এই বহুতল অট্টালিকার দু-কামরার ফ্ল্যাট গুলোয়, আলোর বেণু কিম্বা শিউলির গন্ধ কিছুই পাই না আমি। যেটা পাই সেটা হোল চাপ চাপ সিগারেট আর অ্যালকোহলের বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস।
ভাবলাম মা-কে একটা ফোন করি বাড়িতে, কিন্তু নাহ দেরি হয়ে যাবে, শহরটা ছুটছে, আমাকেও দৌড়াতে হবে।
এই বড় হবার ইঁদুর-দৌড়ের মাঝে, মহালয়ার সকালগুলো আমার কাছে শুধু মর্ত্যে দেবীর আগমনবার্তা না হোলেও, হারিয়ে যাওয়া শৈশবের সাময়িক জাংশনতো বটেই।
ফেসবুক টুইটার স্যোশাল মিডিয়ার অতি ম্যাচিওর যুগে, এভাবেই মহালয়া টিকে থাক, টিকে থাক তার রেডিও-আকাশবাণী-বীরেন্দ্রকৃষ্ণের উচ্চারনে; আর শারদীয়া শুকতারা-আনন্দমেলার উষ্ণ ঘ্রাণের স্মৃতি মাখা হয়ে, তার চির শৈশবকে আঁকড়ে ধরে, আর আমরা?? আমরা তো আসতে আসতে বড় হয়ে গেলাম।