বিসর্জন

07:56







**১**


বাড়ি ভর্তি লোকজন, প্রেস-মিডিয়া, আত্মীয়-স্বজন, পাড়ার লোক, কারোর কমতি নেই। সবাই সহানুভূতি জানাতে এসেছে, বাড়িতে উৎসব লেগে গেছে যেন। হ্যাঁ, উৎসব তো বটেই, তবে সেটা বিসর্জনের…........

অসহ্য যন্ত্রণায় মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, দুহাতে নিজের রগ চেপে ধরে আছে সায়ন্তনি। আর পারছে না সে, চোখের জল চোখেই হারিয়ে গেছে, সেখানে এখন শ্মশানের নীরবতা। নিজেকে ঠাসঠাস করে দুটো চড় মারলো সে, হাত চেপে ধরলো সুমন্ত, “তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? মেয়েটা অনেক কষ্টে ঘুমিয়েছে, আবার জাগাবে নাকি!”


ডুকরে কেঁদে উঠলো সায়ন্তনি, “সব আমারই দোষ, তোমরা সবাই বারণ করেছিলে, আমিই জোর করে স্কুলে পাঠালাম মেয়েটাকে, আমি রাক্ষসী, আমি ডাইনি, আমিই জ্যান্ত খুন করে ফেললাম মেয়েটাকে”।


“মা! মা!” ঘুম থেকে উঠে বসলো তিতলি, খুব ভয় পেয়েছে সে, তাকে বুকে টেনে নিলো সায়ন্তনি। চোখের জলটা লুকিয়ে, হাতের বাঁধনটা আরও মজবুত করে সে বলল। “ভয় নেই রে মা! আমি তো আছি।”
দুজনের আলিঙ্গনবদ্ধ মাথার উপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো সুমন্ত। সামনে অনেক সংগ্রাম, অনেক ঝড় আসবে, কিন্তু তাদের তিনজনকে ঠিক এভাবেই একসাথে থাকতে হবে। আর তাহলেই হয়তো আবার ভোর আসবে, কে জানে!


**২**


“তিতলি! তিতলি! কই গেলি রে, ওমা! ওকি!... দেখো বাপ বেটির কাণ্ড, লোকের ঘুম টুম ভাঙ্গিয়ে মহালয়া দেখে, দুজনে মিলে আবার ঘুম দিচ্ছে। দাঁড়া তোদের মজা দেখাচ্ছি। ওঠ, ওঠ বলছি, স্কুল যেতে হবে।”


“আহহহ! মেয়েটা যখন যেতে চাইছে না, ওকে ছেড়েই দাও না, মহালয়ার দিনটা বাপ বেটি মিলে ছুটি কাটাই একটু।”


“তুমি থামো তো, কুম্ভকর্ণ একটা, লাস্ট এক মাস ধরে এতো কষ্ট করে কবিতাটা শেখালাম মেয়েটাকে, সব জলে দেবো বলে? হেড আন্টি বারবার করে বলে দিয়েছেন, তিতলির একটা কবিতা চাইই চাই, সবাই আসবে আজ... তুমি আর বাগড়া দিয়ো না তো। এই তিতলি ওঠ ওঠ, নাহলে কিন্তু বকা দেবো এবারে।”
“আচ্ছা বাবা তুম জিতা, ম্যায় হারা, তিতলি মা উঠে পড় মা, স্নান করে রেডি হয়ে নে তো, কত লোক আসবে আজ, ওঠ মা, উঠে পড়।”


“নাহ! আমি যাবো না আজ কিছুতেই যাবোনা” ঘুম ভাঙ্গা চোখে, কাঁদতে লেগেছিলো তিতলি, চার বছরের ছোট্ট মেয়েটা.........



**3**


“Aswiner sarada prate beje utheche aloko mandir,

Dharanir bohirakashi ontorhito meghomala;

Prakritir antarakashe jagorito jyotirmoyi jaganmatar aagomono-barta,

Anandamoyi moha mayar padodhyani”....পাড়ার মোড়ে টাঙানো মাইকটা থেকে গান ভেসে আসছিল......


হ্যা,মহামায়াই বটে,নিজের মনে হেসে উঠলেন ডাক্তার রায়,নাহলে আজ মহালয়ার দিনে তার এই হাল করে ছাড়ে শকুনের দল।
যে যোনিপথ তাদের প্রথম আলো দেখিয়েছে,সেটা রক্তাত্ত করে তুলতে বিন্দুমাত্র ভাবেনা এরা, যে জরায়ুতে তাদের সৃষ্টি ,সেটা ধংস্ব করতে এদের হাত কাঁপেনা।
ছি ছি মাত্র চার বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে,জীবন শুরুর আগেই কিভাবে ওরা পারলো একটা ফুলের মত নিস্পাপ শিশুর শৈশবকে গলা টিপে খুন করতে, এ পাপ ঠাকুর সইবেনা,সব সব শেষ হয়ে যাবে,কেউ নিস্তার পাবেনা ওর।।

“মনে মনে কি বিড়বিড় করছেন ডাক্তার সাহেব এই ভর সন্ধ্যাবেলা”?

পেছন ঘুরে তাকালেন ডাক্তার রায়। দেখলেন ৫/৬ টা গুন্ডা চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে,আর তাদের মধ্যমণি,পাড়ার লোকাল কাউন্সিলর অজিত পাণ্ডা।।

পান মশলার ছোপলাগা,কালো কালো দাঁতগুলো বের করে সে বলে চলল,”আপনার একটু সাহায্য দরকার ডাক্তার সাহেব,আমার ছেলের রিপোর্টটা একটু চেঞ্জ করে দিতে হবে আপনাকে,এর জন্য যা টাকা লাগে আমি আপনাকে দেব,সরকার আমাদের,তাই পুলিস নিয়ে চাপ নেবেন না, মোমবাতি মিছিল বিরোধী-দল মিডিয়া সব আমি সামলে নেব,আপনি শুধু রিপোর্ট টা চেপে দেন,ব্যাস আপনার ডিউটি শেষ, সামনে পুজো আসছে, মহালয়ার দিন বলে কথা,তাই ছেলেপুলে উত্তেজিত হয়ে একটু ভুল করে ফেলেছে,আসলে কাঁচা বয়স তো, এমনিতে আমার ছেলে খুব একটা খারাপ নয়” বলেই বিশ্রী শব্দ করে হেঁসে উঠল সেই কালো কালো দাঁতগুলো...

“একটা চড়ে তোমার দাঁত ভেঙ্গে দেব ইতর,আমাকে তোমাদের মত নর্দমার কীট ভেবেছ”,তেড়ে গেলেন ডাক্তার রায়,কিন্তু পারলেন না,বাধা পড়লেন আজিত পাণ্ডার লোকদের হাতে ।

ডাক্তার রায়ের কানের খুব কাছে মুখ এনে সাপের মত হিসহিসিয়ে সে বলল,”ডাক্তার সাহেব,ঐ মেয়েটা কিন্তু মাত্র চার বছরের,পাবলীক দুদিনের মধ্যে ভুলে যাবে সব,কিন্ত আপনার মামনীতো কলেজ যায়,একটা কিছু হয়ে গেলে,কি হবে বলেন দেখি,পাপড়িচাট হয়ে লোকের মুখে মুখে ঘুরবে কিন্তু,ভেবে দেখুন”।।

থরথর করে কেঁপে উঠলেন ডাক্তার সোম,বসে পড়লেন তিনি,বেশ বুঝতে পারলেন, অসুরদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য মহামায়াকে অস্ত্র জুগিয়েছিল যারা,তারা আজ নিজেরাই বড্ড অসহায়,তাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে ।।



**8**



হাওড়া ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা তিনজন,তিতলি আর ওর বাবা-মা।

আগের মত সেই ছটপটে তিতলি আর নেই,যাকে পাঁচটা মিনিট এক জায়গায় ধরে রাখতে বেগ পেতে হত বাবা মাকে,সেখানে স্থান নিয়েছে একটা পুতুল,হাসি কান্না-বিহীন।।

আর সায়ন্তনি-সুমন্ত......তাদের মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে , চোখে যুদ্ধে পরাজয়ের ক্লান্তি,অনেক চেষ্টা করেছিল ওরা,গত কয়েক মাস ধরে পুলিস,মিডিয়া,পার্টির হুমকি,বাড়ীতে আক্রমণ,চোখরাঙ্গানি আর অহেতুক সহনাভুতি সব সহ্য করেও দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছিল ওরা,কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহামান্য আদালত আর প্রমান খুঁজে পেলেন না।।

চলে যাচ্ছে ওরা ,এখান থেকে অনেক অনেক দূরে, যেখানে হয়ত তিতলি সব ভুলে যাবে ,আগের কথা ভুলে আবার আগের তিতলি হয়ে উঠতে পারবে।।

দূরে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে,ঢাক বাজছে,সিঁদুর খেলা চলছে,আলোর রোশনাই.........দেবী বিসর্জনের আর বেশী দেরী নেই.....................।।



You Might Also Like

0 comments

Popular Posts

Like us on Facebook

Flickr Images