** এক **
ঘুম ভেঙ্গে গেলো মিস্টার হান্সের ,ধড়ফড় করে উঠে বসলেন তিনি ।
তবে কি এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি,কতো গান, কত হাসিমাখা মুখ ,কত আলো ,হঠাৎ একটা কানফাটানো প্রচণ্ড শব্দ আর তারপর সব অন্ধকার।।
নিজের অজান্তে কান দুটোকে চেপে ধরলেন তিনি আবার,কাঁপতে লাগলেন থরথরিয়ে।
একটু স্থির হওয়ার পর, উঠে দাঁড়ালেন ,ভালো করে দেখতে লাগলেন চারপাশ।
দেখলেন তিনি একটা সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন ,যেটা সীমাহীন,তার মাঝ দিয়ে দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে ,দিগন্তে রামধনু খেলে গেছে,জায়গাটার বর্ণনা দেওয়া কোন মানুষের পক্ষে বোধহয় সম্ভব নয়,সেটা এতোটাই সুন্দর ।
তিনি বুঝলেন, তিনি পরম-পিতার পারিজাত বাগানে দাঁড়িয়ে আছেন।
বুঝতে পারলেন সেই অভিশপ্ত প্লেনের দুর্ভাগ্য এক যাত্রী তিনি,ধীরে ধীরে তার সব মনে পড়তে লাগল।
কিন্তু তাহলে বব আর শেলির কি হল ,ওরাও কি তবে.........নানা পরম-পিতা নিশ্চয় এতটা নিষ্ঠুর হবেন না ,ওদের তো কোন দোষ ছিল না।
মাথায় অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আসতে লাগল, পরমপিতা নিশ্চয় তাকে নিরাশ করবেন না এটা তার স্থির বিশ্বাস,সারা জীবন তিনি ঈশ্বরের নাম নিয়ে চলেছেন সৎপথে ,
পিতা নিশ্চয় স্বর্গের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার হান্সের জন্য ,দুহাত দিয়ে তাকে বরন করে নেবেন........................আশা নিরাশার অদ্ভুত দোলাচলে দাঁড়িয়ে সেই পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগলেন মিস্টার হান্স।।
** দুই **
চারদিকে দাবানলের মত খবর টা ছড়িয়ে পড়েছে ,২৯৮ টা মৃত্যু বলে কথা,নিউজ পেপার ,টেলিভিশন ,সোশাল নেটওয়ার্ক ,কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, স্বজন হারানো বুক ভাঙ্গা নিশ্বাস গুলো,বাঁধ না মানা চোখের জলগুলো,তারা আছড়ে পড়ছে দেশ কালের সীমা অতিক্রম করে...............
দুটো অস্ট্রেলিয় ফুটফুটে ছেলে মেয়ে আর তাদের বৃদ্ধ দাদু, যারা ছুটি কাটিয়ে ঘরে ফিরতে ছেয়েছিল,
ফুটবলপ্রেমী লিও আর জনি ,যারা তাদের প্রিয় Newcastle United এর খেলা দেখতে ঘর ছেড়েছিল,
মারথা আর স্টুয়ারট,যারা তাদের জীবনের সব থেকে মধুরতম দিন,হানিমুন সেরে ঘরে ফিরছিল,
কিম্বা বেন, যার চোখে কলেজ জীবনের দ্বিতীয় বছরটা শুরু করতে যাওয়ার আনন্দটা চকচক করছিল ........................লিস্টটা ক্রমশ বাড়তেই থাকে ।।
নাহহ এরা কেউই আর এদের নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি।।
কেন পারেনি ??
বোধহয় “পবিত্র পরম পিতা “ চাননি ।।
** তিন **
মিস্টার হান্স সেই পথ ধরে যত এগতে লাগলেন ,খেয়াল করলেন সেই সবুজ ভাবটা যেন কমছে,প্রকৃতি হঠাৎ করেই যেন বন্ধ্যা রুপ ধরতে শুরু করেছে ।
কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা ছিলনা, পরম পিতার যত নিকটে যাওয়া যায়,জীবনতো ততই সুন্দর হয়,সেটাই তো বাইবেল তাকে শিখিয়েছিল,আর তিনি বিশ্বাস ও করেছিলেন ,কিন্তু তবে কেন তার গলাটা শুকিয়ে আসছে,কেনই বা দম নিতে এতো কস্ট হচ্ছে,কেউ যদি একটা গ্লাস জল এনে দিত তাকে এই সময় ,তার আদরের ছোটো নাতনী শেলী কাছে থাকলে ,সে এক দৌড়ে এনে দিত,দুটো বিনুনি নাড়িয়ে হেসে বলত “এই নাও গ্র্যান্ডপা,তোমার জল”
আবার মনে পড়ে গেলো ওদের কথা ,নাহ আরো জোরে জোরে পা চালাতে লাগলেন তিনি, তার ছেলে পুত্রবধূ মারা যাওয়ার পর ঐ দুটো কচি প্রান কেই তো জড়িয়ে বাঁচতে ছেয়েছিলেন তিনি।
ছুটি কাটাতে গেছিলেন ওদের দুজন কে নিয়ে,কি আনন্দেই না কেটেছিল কয়েকটাদিন ,বাচ্চাগুলো খুব খুশি ছিল,কিন্তু কোথা থেকে যে কি হয়ে গেলো ।
তিনি তো স্বর্গে চলে এসছেন,কিন্তু তাকে ছাড়া বাচ্চাগুলোর কি হবে ,ওরাতো তাকে ছাড়া ঐ নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা বাঁচতে পারবেনা, খুব ভালো হত যদি পরম পিতা ওদের কেও মিস্টার হান্সের সাথে এই পারিজাত বাগানে স্থান দিতেন ।
ছি ছি এসব কি ভাবছেন তিনি,চারিদিকে এত সুন্দর দেখে বড়ই স্বার্থপর হয়ে পড়েছিলেন নিজের জন্য ,ঐ কচি প্রানেদের মৃত্যু কামনা করছিলেন তিনি ,
ঈশ্বর ক্ষমা করুক তাকে ,কষ্টে হলেও ওরা বেঁচে থাকুক ,বেঁচে থাকুক তার আয়ু নিয়ে।
কিন্তু ওদিকে কি, অতো চিৎকার কেন ভেসে আসছে ওদিক থেকে,কোটি কোটি মানুষ যেন একসাথে কাঁদছে ,পরম পিতার দেশে এরকমতো হওয়ার কথা লেখা ছিলনা কোথাও ........................।।
** চার **
একটা বাজ পড়ে ঝলসে যাওয়া গাছের পিছনে লুকালেন মিস্টার হান্স,অদ্ভুত একটা ভয় গ্রাস করল তাকে,তিনি লক্ষ্য করলেন পথটা আর কিছু দূর গিয়ে শেষ হয়েছে,আর সেখান থেকেই শুরু হয়েছে একটা দীর্ঘ প্রাচীর,সে প্রাচীরের শেষ দেখা যায় না। আর তাকে ঘিরেই অগুন্তি মানুষ ,ভিড় করে রয়েছে সেই প্রাচীরটাকে ঘিরে,তারা আঁচরে কামড়ে সেই প্রাচীরে ওঠার চেষ্টা করে যাচ্ছে,তাদের শরীর ফালা ফালা প্রাচীরের শক্ত ধাতব দেওয়ালে,তারা রক্তাত্ত ,আহত , যারা অনেকটা উপরে পৌঁছাতে পারছে ,কিছু অস্ত্রধারি বুটজুতো তাদের লাথি মেরে আবার নিচে ফেলে দিচ্ছে ,কিন্তু তারা থামছে না, মাথা খুঁড়ে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেই প্রাচীর অতিক্রম করার, কেননা সেটার পেছনেই তো পরম পিতার আবাস ।।
“ওদের নিশ্চই স্বর্গে প্রবেশের অধিকার নেই ,ওরা নিশ্চয় পাপী” এই বলে মনকে সান্ত্বনা দিলেন মিস্টার হান্স, কিন্তু তাহলে ঐ ভিড়ে বৃদ্ধ পাদ্রী স্যমুয়েল কেন,সে তো তার সারা জীবন ঈশ্বরের নামে দুর্গতদের সেবায় অতিবাহিত করেছিলো ,তাহলে সে কেন প্রাচীর পেরনোর অধিকার পাবেনা,কেন বুটজুতো মিলিটারি পোশাকদের অস্ত্রের খোঁচায় রক্তাত্ত হতে হবে তাকে,
সেই ভিড়ে শেলি আর ববকেও দেখতে পেলেন মিস্টার হান্স,খতবিক্ষত ছোটো শরীর দুটো প্রাচীর ডিঙ্গানোর খেলায় মেতে উঠেছে,কিন্ত সে খেলায় মুখে হাসি নেই,আছে চোখে কালশিটে পড়ে যাওয়া জলের ফোঁটা।
কিন্ত কেন কেন,ওই কচি প্রাণগুলো কি অপরাধ করেছে ,যে তাদের এই শাস্তি ?? কে দেবে তার প্রশ্নের উত্তর,এখানেও কি তবে নিচের পৃথিবীর মত অরাজকতার ক্যান্সার দানা বেধেছে,কিন্তু সেটাতো হওয়ার কথা ছিলনা,কোথায় তার পরম পিতা তার ঈশ্বর ,তিনি এসে কেন এই বুটজুতোগুলোকে শাসন করছেন না,কেন বলছেন না,“ তোমরা আমার স্বর্গটাকে নরক বানিয়ে ফেলেতে পারনা,তোমাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে ” ।।
নাহ , তার করা প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর পাননি মিস্টার হান্স।
তবে সেই ধাতব দেওয়ালে অসংখ্য মানুষের মাথা ঠোকার আর্তনাদে,তাদের বুক ফাটা কান্নায়, বুটজুতোর পদশব্দে,তাদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ,দিগন্তের ম্লান হয়ে যাওয়া ভাঙ্গা রামধনুটা ,মিস্টার হান্সের কানে একটা উত্তর বয়ে নিয়ে আসে, “ পরম পিতা আর নেই ,ঈশ্বর আর নেই father has left the home,a long time ago”